ঢাকা ০৮:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন সৌদি ফেরত সুমি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৩:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৯
  • ১৬৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  সুমি আক্তার। গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতি সেনপাড়া গ্রামে। গ্রামের স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। বাবা রফিকুল ইসলাম একজন দিনমজুর। চার ভাই বোনের মধ্যে বড় সুমি। বাবার অভাবের সংসারে নুন আন্তে পান্তা ফুরায়। তাই বাধ্য হয়ে অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ঢাকায় আসেন সুমি। চাকরি নেন একটি গার্মেন্টসে।

সেখানেই পরিচয় হয় আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের সঙ্গে। ছয় মাস পর বিয়ে করেন তাকেই। বিয়ের পর জানতে পারেন, আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। বাধ্য হয়ে সতীনের সঙ্গে সংসার শুরু করেন। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তান হয়।

গত ৩০ মে স্বামী নুরুল ইসলামের পরামর্শে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের মাধ্যমে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরবের রিয়াদে যান। সেখানে গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন সুমি। সৌদিতে থাকা প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে তার ওপর চলে নির্যাতনের স্টিম রোলার। বন্দিশালা থেকে দেশে ফিরতে নানা কাটখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে।

দেশে ফিরে সুমি নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা করেন সাংবাদিকদের কাছে। সুমি জানান, তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। দুই বছর আগে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নেন। সেখানেই আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়। ছয় মাস পর তাকেই বিয়ে করেন। সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই প্রথম কর্মস্থলে মালিক তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও মারধর করেছে। হাতের তালুতে গরম তেল ঢেলে দিত ও রুমে আটকে রাখত। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই মালিক তাকে না জানিয়ে সৌদি আরবের ইয়ামেন সীমান্ত এলাকা নাজরানের এক ব্যক্তির কাছে প্রায় ২২ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে দেন।

ওই মালিকও তাকে নির্যাতন করত। উদ্ধার হওয়ার আগে ১৫ দিন তাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার দেয়া হয়নি। তার মোবাইলফোনটিও কেড়ে নিয়েছিল। এক সময় খুব কান্নাকাটি করে স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য মোবাইলফোনটি চেয়ে নেন। বাথরুমে গিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন। সেই ভিডিওতে নির্যাতনের কথা জানান এবং স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই ভিডিও তার স্বামী ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিত করেন। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সুমিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়।

সুমি বলেন, ‘সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি কনসুলেট আব্দুল হক সৌদি পুলিশের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’ সুমি আরো জানান, বাবা-মায়ের নিষেধ অমান্য করেই স্বামী নুরুল ইসলামের কথামতো সৌদিতে যান তিনি। দালালচক্র যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে, সে কথা তিনি প্রথমে জানতেন না। মালিকের (কফিল) কাছে জানতে পারেন, বাংলাদেশি প্রায় চার লাখ টাকায় তার কাছে সুমিকে বিক্রি করা হয়।

সুমি বলেন, ‘প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলত নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতেও রেহাই পেতাম না। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা। শুধু তাই নয়, অন্যত্র বিক্রি করার পর সেখানেও আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো।’বিদেশ যাওয়ার আগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ঢাকা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে ১ মাসের গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ নেন সুমি।‘রূপসী বাংলা ওভারসিজে’র মালিক ভালো কাজের কথা বলে (হাউস কিপিং) তাকে সৌদিতে পাঠায় দাবি করে সুমি বলেন, ‘তারা আমাকে ভিসা ও টিকিট দেয়। কিন্তু আমি যে ৪ মাস সেখানে কাজ করেছি। এজন্য মাত্র ১৫ হাজার টাকা আমার স্বামীর হাতে দিয়েছে। আর কোনো টাকা আমাকে দেয়া হয়নি।’

সুমি আক্তারের স্বামী নুরুল ইসলাম জানান, মিরপুর-১ এলাকার সাজেদা বেগম নামে এক দালালের মাধ্যমে সুমি বিদেশ যান। সাজেদা বেগমের সঙ্গে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের’মালিক আকতার হোসেন ও তার কয়েকজন সহযোগী তাকে সৌদি আরবে পাঠায়। তারা মোট এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তিনি রাজধানীর পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

সুমির মা মল্লিকা বেগম বলেন, ‘নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর একদিনও স্বস্তিতে ঘুমাতে পারিনি। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’

সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, অভাব-অনটনের সংসারে কিছু টাকা কামানোর জন্য বিদেশে গিয়েছিল মেয়েটা। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

এর আগে শুক্রবার সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সে সময় ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের পরিচালক ও উপ-সচিব মো. জহিরুল ইসলাম বিমানবন্দরে ছিলেন।

বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়। বিকেলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বোদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর প্রধানের উপস্থিতিতে সুমিকে তার বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মল্লিকা বেগমের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন সৌদি ফেরত সুমি

আপডেট টাইম : ১২:১৩:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  সুমি আক্তার। গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতি সেনপাড়া গ্রামে। গ্রামের স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। বাবা রফিকুল ইসলাম একজন দিনমজুর। চার ভাই বোনের মধ্যে বড় সুমি। বাবার অভাবের সংসারে নুন আন্তে পান্তা ফুরায়। তাই বাধ্য হয়ে অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ঢাকায় আসেন সুমি। চাকরি নেন একটি গার্মেন্টসে।

সেখানেই পরিচয় হয় আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের সঙ্গে। ছয় মাস পর বিয়ে করেন তাকেই। বিয়ের পর জানতে পারেন, আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। বাধ্য হয়ে সতীনের সঙ্গে সংসার শুরু করেন। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তান হয়।

গত ৩০ মে স্বামী নুরুল ইসলামের পরামর্শে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের মাধ্যমে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরবের রিয়াদে যান। সেখানে গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন সুমি। সৌদিতে থাকা প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে তার ওপর চলে নির্যাতনের স্টিম রোলার। বন্দিশালা থেকে দেশে ফিরতে নানা কাটখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে।

দেশে ফিরে সুমি নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা করেন সাংবাদিকদের কাছে। সুমি জানান, তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। দুই বছর আগে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নেন। সেখানেই আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়। ছয় মাস পর তাকেই বিয়ে করেন। সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই প্রথম কর্মস্থলে মালিক তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও মারধর করেছে। হাতের তালুতে গরম তেল ঢেলে দিত ও রুমে আটকে রাখত। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই মালিক তাকে না জানিয়ে সৌদি আরবের ইয়ামেন সীমান্ত এলাকা নাজরানের এক ব্যক্তির কাছে প্রায় ২২ হাজার রিয়ালে বিক্রি করে দেন।

ওই মালিকও তাকে নির্যাতন করত। উদ্ধার হওয়ার আগে ১৫ দিন তাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার দেয়া হয়নি। তার মোবাইলফোনটিও কেড়ে নিয়েছিল। এক সময় খুব কান্নাকাটি করে স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য মোবাইলফোনটি চেয়ে নেন। বাথরুমে গিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন। সেই ভিডিওতে নির্যাতনের কথা জানান এবং স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই ভিডিও তার স্বামী ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিত করেন। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সুমিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়।

সুমি বলেন, ‘সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি কনসুলেট আব্দুল হক সৌদি পুলিশের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’ সুমি আরো জানান, বাবা-মায়ের নিষেধ অমান্য করেই স্বামী নুরুল ইসলামের কথামতো সৌদিতে যান তিনি। দালালচক্র যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে, সে কথা তিনি প্রথমে জানতেন না। মালিকের (কফিল) কাছে জানতে পারেন, বাংলাদেশি প্রায় চার লাখ টাকায় তার কাছে সুমিকে বিক্রি করা হয়।

সুমি বলেন, ‘প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলত নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতেও রেহাই পেতাম না। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা। শুধু তাই নয়, অন্যত্র বিক্রি করার পর সেখানেও আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো।’বিদেশ যাওয়ার আগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ঢাকা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে ১ মাসের গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ নেন সুমি।‘রূপসী বাংলা ওভারসিজে’র মালিক ভালো কাজের কথা বলে (হাউস কিপিং) তাকে সৌদিতে পাঠায় দাবি করে সুমি বলেন, ‘তারা আমাকে ভিসা ও টিকিট দেয়। কিন্তু আমি যে ৪ মাস সেখানে কাজ করেছি। এজন্য মাত্র ১৫ হাজার টাকা আমার স্বামীর হাতে দিয়েছে। আর কোনো টাকা আমাকে দেয়া হয়নি।’

সুমি আক্তারের স্বামী নুরুল ইসলাম জানান, মিরপুর-১ এলাকার সাজেদা বেগম নামে এক দালালের মাধ্যমে সুমি বিদেশ যান। সাজেদা বেগমের সঙ্গে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের’মালিক আকতার হোসেন ও তার কয়েকজন সহযোগী তাকে সৌদি আরবে পাঠায়। তারা মোট এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তিনি রাজধানীর পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

সুমির মা মল্লিকা বেগম বলেন, ‘নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর একদিনও স্বস্তিতে ঘুমাতে পারিনি। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’

সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, অভাব-অনটনের সংসারে কিছু টাকা কামানোর জন্য বিদেশে গিয়েছিল মেয়েটা। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

এর আগে শুক্রবার সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সে সময় ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের পরিচালক ও উপ-সচিব মো. জহিরুল ইসলাম বিমানবন্দরে ছিলেন।

বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়। বিকেলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বোদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও পাঁচপীর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর প্রধানের উপস্থিতিতে সুমিকে তার বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মল্লিকা বেগমের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়।